আজ নেতাজীর ১২৫তম জন্মদিন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র আমাদের বাঙালিদের কাছে এক বিরাট আবেগের নাম। শৈলেশ দে র লিখিত ‘আমি সুভাষ বলছি’ পড়েই আমাদের অনেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হাতেখড়ি।

ছোটবেলা থেকেই আমরা সেই আবেগের শরিক, বেশ বেশিমাত্রায়। তার কারণও আছে। আমাদের পৈতৃক বাড়ি রাজপুরে। পড়েছি হরিনাভি স্কুলে। নেতাজির আদি বাড়ি চাঙড়িপোতা হরিনাভির খুব কাছেই। সেই জায়গার ও তার সংলগ্ন রেল স্টেসনের নাম –‘সুভাষগ্রাম’।

সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ বসু আমাদের হরিনাভি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তী কালে স্কুল-কমিটিতেও ছিলেন কিছুদিন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে আমরা হরিনাভি স্কুল থেকে হেঁটে সদলবলে শিক্ষকদের অভিভাবকত্বে সেই ভবন পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।
এছাড়াও নেতাজির জন্মদিনে আমাদের রাজপুর – হরিনাভি অঞ্চলে এক অদ্ভুত কাণ্ড হত। যত বছরের জন্মদিন, ২৩শে জানুয়ারি, জন্মমুহূর্তে ঠিক ততবার শাঁখ বাজিয়ে জন্মদিন উদযাপন হত। ছোটবেলার বিভিন্ন বাড়ি থেকে সেই অনুরণিত শঙ্খধ্বনি শোনার স্মৃতি আজও অমলিন।
তারপরে বড় হওয়ার পর নেতাজি নিয়ে অনেক চর্চার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। সবচেয়ে বেশি চর্চা সম্ভবত তাঁর মৃত্যু রহস্য নিয়ে। তিনটি কমিশন, অজস্র বই, এছাড়া অনেক তথ্য – সব কিছু মিলিয়েও বিভ্রান্তি এখনো কাটেনি।
তবে আমার নিজের ধারণা নেতাজি চর্চার বিশেষ প্রয়োজন আছে। নেতাজি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর, তাই তাঁর মৃত্যুরহস্যের চেয়ে জীবনদর্শন আমার কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক এবং আকর্ষণীয়। এই নিয়ে শুরু করার জন্য নবপ্রজন্মের কাছে দুটি বইয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
শেখর বসু আমার অত্যন্ত প্রিয় ছোটগল্পকার। সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকে তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল নেতাজি পত্নী এমিলি শেংকেল ও অনীতা বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের। সেই অপূর্ব, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে যে বইটি তার নাম – ‘নেতাজির সহধর্মিণী’।

অতি সম্প্রতি এই বইটি আমার হস্তগত হলেও বইটি লিখিত হয়েছে সাতের দশকের একেবারে শেষদিকে – ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেই সময়, তিনি সৌভাগ্যবশতঃ ভিয়েনাতে সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এই মহীয়সী নারীর। সেখানে তাঁর সঙ্গে আরো আলাপ হয় নেতাজীর ভাইঝি মাধুরী বসুর।
নেতাজীর অন্তর্ধানের মত নেতাজীর বিবাহ ব্যাপারটি বাঙালিদের কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছিল। নেতাজী স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে নিজেকে গড়েছিলেন সুতরাং তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যস্ত থাকাকালীন বিবাহবন্ধনে জড়াতে পারেন তা তো কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগবেই।
ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে বইটি। ১৯৪৩ সালে জার্মানি থেকে সাবমেরিনে দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে রওয়ানা হবার ঠিক আগেই একটি চিঠি লেখেন তাঁর মেজদাদা শ্রী শরৎচন্দ্র বসুকে। সেই চিঠিতে তিনি তাঁর মেজদাদাকে তাঁর অবর্তমানে স্ত্রী-কন্যার ভার নিতে অনুরোধ করেন। চিঠিটি অবশ্য অনেক পরে হস্তগত হয়েছে শরৎচন্দ্রের। পরে ছোট বইটির সপ্তম অধ্যায়ে লেখক বিস্তারিত জানিয়েছেন ১৯৫১ সালে সংবাদপত্রে এই চিঠি প্রকাশের কথা।
এমিলির সঙ্গে দেখা করার আগেই লেখক চিত্তাকর্ষক সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের আগে তাঁর মানসিক উত্তেজনার কথা জানিয়েছেন। মাঝে মাঝে বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি, ছোট ছোট উল্লেখ – , কিন্তু তা আমাদের মনকে কখনো ভারাক্রান্ত করে না। বরং নিজের অজান্তেই আমরা প্রায় লেখকের সেই যাত্রার সঙ্গী হয়ে পড়ি।
দেখা করা ও গল্পগুজবের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। প্রায় ঘন্টা পাঁচেক তিনি থাকতে পেরেছিলেন এই মহীয়সী নারীর সঙ্গে। জানতে পেরেছিলেন বার্লিনে তাঁদের বাড়ির কথা। ভিয়েনার সেই ঘরটিতে দেখতে পেরেছিলেন সেই ঘরে নেতাজীর অনেক ছবি। বইয়ের তাকে দেখতে পান নেতাজী লিখিত সেই বিখ্যাত বইটি – দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল – ১৯২০ – ১৯৩৪। সঙ্গে সঙ্গে মনে করতে পারেন সেই অসামান্য ইতিহাস। বার্লিনে এই ইতিহাস রচনাকালীনই তাঁর ভবিষ্যৎ পত্নীর সঙ্গে পরিচয় নেতাজীর।
এছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ আছে। উল্লেখযোগ্য এমিলির ভারতের অর্থসাহায্য প্রত্যাখ্যান। তাঁর আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল যে তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর পাঠানো টাকা নিতে অস্বীকার করেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল – ‘Subhas would not have liked this.’ আছে এ সি এন নাম্বিয়ারের কথা। তখনো জীবিত ছিলেন নেতাজীর এই সঙ্গী। প্রায় নেতাজীর সমবয়সী মানুষটিকে কলকাতা এসে চিঠি লিখেছিলেন লেখক। উত্তরও পেয়েছিলেন। আগ্রহীরা আরো খোঁজ করে দেখতে পারেন এই মানুষটি সম্পর্কে। মানুষটি বাঙালিদের কাছেও খুব পরিচিত নন। তাঁকে নিয়ে লিখিত একটি বই – ‘A Life in Shadow: The Secret Story of A.C.N. Nambiar’!
এরকম আরো অনেক ইঙ্গিত আছে বইটিতে যা আমাদের নেতাজীর জীবন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে পারে। আমরা অদ্ভুতভাবে লক্ষ করি এমিলি ঝাঁসির রাণী ব্রিগেডের ছবি দেখতে দেখতে মনে করেন – ‘মেয়েদের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ছিল সুভাষের।’ তবে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী সম্ভবত তাঁর স্বগতোক্তি –‘আমার প্লেনে চড়তে ভয় করে।’ মনে পড়ে যায় সেই দুর্ঘটনার কথা।
শেষে লেখক আপসোস করেছেন – কেন এমিলির নেতাজীকে নিয়ে লেখা কোন বই প্রকাশের আগ্রহ দেখালেন না কোন প্রকাশক? ‘তাঁর দেখা নেতাজী’? এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
নেতাজীর জীবনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ অধুনা অবহেলিত একটি বড় অধ্যায় হল আবিদ হাসানকে সঙ্গী করে সাবমেরিনে চড়ে জার্মানি থেকে দক্ষিণ এশিয়া আগমন। এই পর্যায় নিয়ে শেখর বসুর অপর বইটির নাম – ‘ডুবোজাহাজে নেতাজি’।

বইটির নিবেদন অংশে লেখক বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি বইটি লিখতে শুরু করেন। উদ্যোগটি এসেছিল প্রধানত আনন্দবাজারের সম্পাদক অভীক সরকারের কাছ থেকে।
নেতাজীর সঙ্গে আবিদ হাসানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৪৩ সালের ঐ বিখ্যাত যাত্রার কিছু আগেই। আবিদ তখন বার্লিনে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। নেতাজীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর দ্বিতীয়বার আবার যখন দেখা হয় তখন নেতাজীর নাম সুভাষচন্দ্র নয় – অরল্যান্ডো মাৎসোটা, ইটালিয়ান। এই ছদ্ম পরিচয়ে নেতাজী তখন ইউরোপে ঘুরছেন।
তারপরে নেতাজীকে হিটলার যখন জার্মানি থেকে ডুবোজাহাজে দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে আসার ব্যবস্থা করে দেন তখন নেতাজীর সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর সেই বিখ্যাত যাত্রার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন আবিদ। পদে পদে বিপদ! নেতাজী জানতেন সেকথা আর তাই তিনি তাঁর মেজদাদার উদ্দেশে লিখে যান উপরোক্ত চিঠিটি।
এই যাত্রার সময় নষ্ট করতে চাননি নেতাজী। তিনি জানতেন তাঁর সামনে কী কাজ রয়েছে। তাই আবিদকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণ পরিকল্পনা করতে বসে যান। এমনকি জাপানী সেনাপতি তোজোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি কখনো আবিদকে তোজো সাজাতেন, কখনো নিজেই তোজো সাজতেন। এতটাই সিরিয়াস ছিলেন তিনি এই মহড়ার ব্যাপারে। এছাড়া আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠন কেমন হবে তা নিয়েও দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
আবিদের কাছেই আমরা জানতে পারি কী অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন নেতাজী! সিঙ্গাপুরে এসেই তিনি যে বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করবেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রস্তুতি হয়েছিল ঐ নৌযাত্রায়।
নেতাজী যে শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ জয় করতে চাননি, তার পিছনে তাঁর পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল তার বেশ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই ছোট্ট বইটিতে।
তবে শুধু সেই যাত্রা নয়, আরো কিছু প্রাসঙ্গিক লেখা আছে এই বইটিতে। আমার মতে, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দেশবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী কে নিয়ে লিখিত অধ্যায়টি। ভারতের রাজনীতিতে আজ প্রায় অপরিচিত দেশবন্ধুর জন্মের সার্ধশতবর্ষ চলে গেল বিনা আড়ম্বরেই। অথচ এককালে গান্ধীজীর সমান মর্যাদা পেতেন এই মানুষটি। ১৯২৫ সালে তাঁর অকালমৃত্যুর পর সুভাষ চেয়েছিলেন তাঁর অন্য ‘মা’ বাসন্তী দেবী এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পরপর স্বামী ও পুত্রকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন বাসন্তী, তাই সম্ভবত তিনি সুভাষের অনুরোধ রাখতে পারেননি।
এই দুটি ছোট বই থেকে আমাদের সুভাষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বেশ কিছু আভাস লাভ হয়। সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। লেখক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন সুভাষের স্থির বিশ্বাস ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া দেশকে স্বাধীন করা অসম্ভব এবং তার জন্য চাই সেনাবাহিনী ও আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম। আমরা আরো জানতে পারি জার্মানি ও জাপানের কাছ থেকে যে সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল ঋণ। প্রবাসী ভারতীয়দের অর্থে গঠিত তহবিল থেকে তা ধীরে ধীরে শোধ করা সম্ভব হচ্ছিল।
নেতাজী নারীদের শুধুমাত্র শ্রদ্ধাই করতেন না, মনে করতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের যোগ্যতা আছে পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগদান করার। এমনকি নারীদের যুদ্ধের পোশাক নিয়েও তাঁর আবিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
আবিদের ভাষ্য থেকে এও জানা যায় সাম্প্রদায়িকতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ধর্মকে ব্যক্তিগত স্তরে রাখার কঠোর নির্দেশ ছিল নেতাজির। এই সম্পর্কে চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের মন্দিরে যাওয়ার ঘটনাটিও গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুরের ধনী চেট্টিয়ার হিন্দুদের মন্দিরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। নেতাজি তাই সেখানে দশেরা উৎসবে যোগদান করতে চাননি। চেট্টিয়ার সম্প্রদায় তখন দশেরা উৎসবে সর্ব ধর্ম সম্মেলন করে নেতাজি ও তাঁর সেনাবাহিনীর সদস্যদের সসম্মানে নিয়ে যান।
বস্তুতঃ দুটি বই নেতাজির জীবনের অনেক অজানা দিক সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলী করে তুলতে পারে। অবশ্যই সবাই যে সমপরিমাণ আগ্রহী হবেন তা নয়। কিন্তু যাঁরা নেতাজির মৃত্যু রহস্যের চেয়ে তাঁর জীবন দর্শন নিয়ে বেশি আলোচনা চান, তাঁদের চর্চা শুরু করার জন্য এই ছোট বই দুটি বেশ আকর্ষণীয়।
প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত রোমাঞ্চকর নেতাজির ডুবোজাহাজের যাত্রা পড়তে পড়তে মনে হয়, এই অংশটি নিয়েও কোন কাহিনিচিত্র বা তথ্যচিত্র রচিত হতে পারতো। এখন তো বি ভিন্ন ওয়েব সিরিজও হচ্ছে, আশা রাখছি কোনদিন এই আশা পূরণ হবে।