জয়নগরের ‘ছোটমামা’

আমাদের রাজপুরের যৌথ পরিবারে দুটি মামারবাড়ি ছিল – প্রচুর পরিমাণ মামা, মামী, মাসী, মেশোমশাইয়ের মধ্যেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা।
আমার বাবা একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, ‘জানিস, আমাদের পরিবারে ও সমাজে অবিবাহিত লোকেদের একটা বড় ভূমিকা থাকে, সব্বাইকে একসঙ্গে ধরে রাখার জন্য। তাঁদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনা।”
আমাদের বৃহৎ পরিবারে আমি নিজের জীবন দিয়ে দুজন অবিবাহিত মানুষের খুব বড় অবদান দেখেছি, বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলতেও দেখেছি। একজন আমার মেজজেঠু, যিনি চলে গেছেন ২০০১ সালে। অন্যজন আমাদের জয়নগরের ছোটমামা, যিনি সদ্য প্রয়াত।
আমরা দুই বাড়ির মামাদের মধ্যে বিভ্রান্তি এড়াতে ‘ল্যান্সডাউন’, ‘বালিগঞ্জ’, ‘জয়নগর’ ইত্যাদি বিশেষণ লাগাতাম। বলার সময় নয়, শুধু অন্য কারুকে প্রসঙ্গ বোঝানোর জন্য।
প্রথম কবে ছোটমামাকে দেখেছি তা আজ মনেও পড়ে না। তবে সত্তরের দশকের প্রথমদিকে মেজমাসীরা বারেন্দ্রপাড়াতে বাড়ি করার সময় থেকেই আমাদের বাড়িতে ছোটমামার যাতায়াতের কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে। সেই সময়টা বাংলার রাজনীতিতে বেশ টালমাটাল সময়। আমাদের বাড়িতে বাবা, মেজজেঠু ও তাঁদের বন্ধুবান্ধবরা বামপন্থী, ছোটমামাও তাই। এলেই রাজনীতির আলোচনা হত। আমার কাকা, যিনি ছোটমামার ভগ্নীপতি, তিনি আবার বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও তখন কিন্তু এমন পরিস্থিতি খুব অস্বাভাবিক ছিল না। সেই নিয়ে বেশ মজাও হত।

১৯৭৭ সালের সেই নির্বাচনের ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে। নির্বাচনের বুথ হয়েছে আমাদের বাড়ির সামনেই বাংলা স্কুলে। ছোটমামা নিজে ভোট দিয়ে এসেছেন, এসে বাবাদের সঙ্গে আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই সময় ছোটমামা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন বাড়ির তিন মহিলা, আমার মা, কাকিমা এবং ছোটপিসী তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করেননি। তখন প্রায় সময় শেষ হয়ে এসেছে। ছোটমামা তাগাদা দিলেন ‘কি সর্বনাশ, এমন ভুল কীকরে হয়? যদি দিলীপ চক্রবর্তী (জনতা দলের প্রার্থী) তিন ভোটে হেরে যায়, আফসোসের সীমা থাকবে না তো।’ ব্যস! তাগাদা দিয়ে তিনজনকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে ভোট দিইয়ে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে ফিরলেন। নির্বাচনের ফলে অবশ্য সেই হাসি প্রতিফলিত হয়েছিল।

ছোটমামা অবশ্য তর্কাতর্কিতে খুব বিশেষ ভাগ নিতেন না। আমার অন্য মামারা, দু পক্ষেরই, সে ব্যাপারে বেশ পটু ছিলেন। ছোটমামা মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতেন। ছোটমামার কথা বলতে গেলেই নতুনমামার কথা এসে যায়। দু ভাই, একসঙ্গে থাকতেন, কিন্তু তাঁদের দুজনের মনোভাব ছিল একদম অন্যরকম। নতুনমামা ছিলেন ভীষণ আবেগময়, উচ্চকিত, আপাদমস্তক শৌখিন মানুষ, নিজের পছন্দের ব্যাপারে সুস্পষ্ট। অন্যদিকে ছোটমামা স্থিতধী, স্বল্পবাক এবং তুলনায় নিরুত্তাপ। এই কন্ট্রাস্ট আমাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল, সে নিয়ে আমরা ছোটরা খুব মজা পেতাম। একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে, সেটা আমার দিদির বিয়ের সময়।

বিয়ের তারিখ ছিল ২৭মে, ১৯৮৬। প্রচণ্ড গরম, বাড়ি ভর্তি লোক। অনেক যুগ পর বাড়িতে মেয়ের বিয়ে – হৈ চৈ, গণ্ডগোল, লাফালাফি! আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে গেছি, গরমে নাজেহাল অবস্থা। বাসর হচ্ছে, এদিকে আমার সঙ্গে বড়মামার (ল্যান্সডাউন) তর্ক হচ্ছে- এরকম বিরাট হৈচৈ, খরচ করে বিয়ে হওয়া উচিত কিনা! বড়মামা বাঙালী ও ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে লড়ে যাচ্ছে, আমিও তর্ক করে যাচ্ছি উলটো দিকে। ছোটমামা কিন্তু গম্ভীর ভাবে ঘাড় নেড়ে বড়মামাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন – আমার আধুনিক ভাবনাকেও বড়মামার সম্মান জানানো উচিত। আমার কথারও কিছু যুক্তি বেশ গ্রহণযোগ্য। তর্ক শেষ হতে হতে রাত কাবার। সকালে বাবা এসে অবাক – বড়মামা ও ছোটমামাকে প্রশ্ন – ‘সেকি! আপনারা বাসরে যাননি?’ বড়মামা অবশ্য হাসিমুখেই বলল, ‘নাঃ! বিজন, তোমার ছেলে সারারাত আমাদের বাসরের চেয়ে বেশি মনোরঞ্জন যুগিয়েছে!’ আমার মামারা এরকমই ছিলেন।

ছোটমামার সঙ্গে আরো একজনের দুর্দান্ত সম্পর্ক ছিল, তিনি আনন্দমামা। অবিবাহিত ছোটমামা ছিলেন আনন্দমামার যাকে বলে ‘খেলার সাথী’। সে সম্পর্কে একটু বিস্তারিত লিখতে ইচ্ছে করছে। আনন্দমামাদের চৌরঙ্গীতে একটা ক্লাব ছিল – কথাকলি। ছোটমামাও সে ক্লাবের মেম্বার ছিলেন।

দিদির বিয়েতে গরমে পোড়ার অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পাওয়া গিয়েছিল পরের বছর বোনের বিয়েতে। সেটা ঘটেছিল নভেম্বর মাসে। মা – কাকিমাদের রাজপুরের শীতে কাজ করতে কষ্ট হলেও আমাদের ছোটদের খুব আনন্দ হয়েছিল। বৌভাত খেয়ে আমরা কনেযাত্রীরা সদলবলে বাসে করে হাওড়া থেকে ফিরছি – আনন্দমামা বাসে উঠে নাটকীয় ভাবে ঘোষণা করলেন – ‘খুব আনন্দ হয়েছে?’ আমরা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলতেই বললেন – ‘তোমাদের চিন্তা নেই, পরের বিয়ের জন্য আমাদের পাত্র রেডি, পাত্রী খোঁজা চলছে!’ আমরা না বুঝতেই চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন – টার্গেট ছোটমামা। ছোটমামার অবস্থা করুণ! একগাড়ি ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভাইপো, ভাইঝি, বৌ, জামাই – তাদের সামনেই কি কেলেঙ্কারি! আনন্দমামা সিরিয়াস – আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোকে কিন্তু আসতেই হবে, এখন থেকেই ব্যবস্থা কর!’ আমি ঘাড় নাড়বো না হাসবো, ভাবতে ভাবতেই চৌরঙ্গি এসে গেল। আনন্দমামা নেমে যেতে ছোটমামা যেন একটু স্বস্তি পেলেন। পরের বার আবার আমরা বালিগঞ্জে হেমছায়ার ফ্ল্যাটে গেছি। আনন্দমামা হাজির! এসে ঘুরে ঘুরে কিভাবে ছোটমামার বিয়ের পর নতুন ঘর ঠিক করবেন চিন্তা করছেন। আমি তখন সদ্য বিবাহিত, নতুন বৌ এর সামনে ছোটমামা আরো অপ্রস্তুত – আনন্দমামা ছাড়বেন না, ‘আরে ওরা এখন সব বড় হয়ে গেছে, ভম্পু (ছোটমামার ডাকনাম) কিচ্ছু ভেবনা। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে!’ নিতান্ত ভালোমানুষ ছোটমামা নাজেহাল!

ছোটমামা টাইমের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। ঠিকঠাক কাজ টাইমে না হলে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। সেবারে আমার ভাইয়ের বিয়ের সময় এমনই দুশ্চিন্তার ব্যাপার ঘটেছিল। বিয়ের দিন, বর তো বরকর্তা সমেত গাড়িতে চলে গেল, বরযাত্রীর গাড়ি আর আসে না। তখন এত মোবাইল ছিল না, তাও ফোন হচ্ছে – আমার মেজজেঠু যেহেতু যাবে না, বাবা চলে গেছেন বরকর্তা হয়ে, ছোটমামাই লিডার। ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন, পায়চারি করছেন – একবার তো বলেই ফেললেন – ‘আচ্ছা, এত দেরি হচ্ছে, কি করবে?’ আমি বললাম – ‘যত দেরি হোক, আমাদের তো যেতেই হবে। ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী যাবো না?’ ছোটমামা খুঁতখুঁত করছেন – ‘এত দেরি হচ্ছে! যাওয়া আবার ফিরে আসা – অনেক দেরি হয়ে যাবে না?’ যাইহোক কিছুক্ষণের মধ্যে শেষমেশ বাস এসে গেল, ছোটমামাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ঐ সময়েই কে খবর আনলো যে ছোটমামার ৬৫ বছর পূর্ণ হবে। ব্যস, হৈ হৈ করে জন্মদিনের অনুষ্ঠানও হল, মোমবাতি জ্বালিয়ে নিভিয়ে সব্বাই মিলে আনন্দ হল। ছোটমামা লজ্জা পেলেও খুব খুশি হয়েছিলেন, আমরাও সকলে এরকম এক নিরলস, স্বল্পবাক, সদানন্দ মানুষকে বরণ করতে পেরে নিজেরাই গর্বিত বোধ করেছিলাম।


শেষবার আমার কোন একটি লেখা, সম্ভবতঃ কোন আত্মীয় বিয়োগের পর, তাঁর চোখে পড়েছিল। ফোনে কথাও হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিলেন – ‘রিটায়ারের আর কত দেরী?’

শেষপর্যন্ত আমার চাকরীর ছুটি আর তাঁর জীবনের ছুটি – প্রায় মিলে গেল। আমাদের আগের প্রজন্মের আরো একটি তারা এভাবেই খসে পড়ে গেল। হয়তো এটা ঠিক, অসুস্থতা আরো বাড়লে সেই সদা পরোপকারী মানুষটির পক্ষে সম্মানজনক হত না!

তবু কেন মন উদাস হল! প্রণাম।

2 thoughts on “জয়নগরের ‘ছোটমামা’

  1. মন ছুঁয়ে গেল, অপূর্ব লেখনী…🙏🙏🙏

    On Mon, 25 Jan 2021, 00:48 ভাবনা আমার পথ খুঁজে চলে, wrote:

    > bhaskarbose1960 posted: ” আমাদের রাজপুরের যৌথ পরিবারে দুটি মামারবাড়ি ছিল –
    > প্রচুর পরিমাণ মামা, মামী, মাসী, মেশোমশাইয়ের মধ্যেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা।আমার
    > বাবা একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, ‘জানিস, আমাদের পরিবারে ও সমাজে
    > অবিবাহিত লোকেদের একটা বড় ভূমিকা থাকে, সব্বাইকে একসঙ্গে ধরে রাখা”
    >

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s