বেশ কয়েকবছর ধরে রোববারের সকালের কথাবার্তা চলতো এরকম। আমি শুরু করতাম – মেজমামা উত্তর দিত,
- গুড মর্ণিং! শরীর ঠিক?
- একদম। ফাসক্লাস!
- অফিস চলছে?
- অফিস, বাজার, আড্ডা – সব চলছে। রবিবার সকালে ‘ভগবান’ এর ফোন এলে মন ভালো হয়ে যায়।
আমি রিটায়ার করার পর একটু অন্যরকম হয়ে গেল।
- মেজমামা, আমি রিটায়ার করে গেলাম – তুমি এখনো অফিস যাবে? আমার লজ্জা করছে।
- কেন বাবা? আমার চাকরিই জীবন। খুব ভালো লাগে অফিসে যেতে।
- যাঃ! তোমার ভাইয়েরা রিটায়ার করে গেল, -! এখন ভাগনেও।
- ভগবান, শোন। তিনি আমাকে আমাকে যতদিন যেতে দেবেন, ততদিন যাবো।
‘ভগবান’ না কি আমি! ভাগনে নাকি জগন্নাথ অর্থাৎ ভগবান। কে জানে। তবে মেজমামার গীতা পাঠের খাতিরে আমার মধ্যেও হয়তো কিছু ভগবানত্ব আরোপিত হয়ে থাকবে। সত্তরের শেষে বা আশির প্রথমে মামারবাড়ি থেকে আমি পরীক্ষা দিতাম। তখন সকাল শুরুই হত মেজমামার গীতাপাঠ দিয়ে। সব মনে থাকে না কিন্তু ‘প্রাত সমুত্থায়’ টা খুব মনে থাকতো। আর ‘যথা নিযুক্তোহসি তথা করোমি’! কোন দিন একটু দেরী হলে আমি আবার খোঁচাতাম – ‘আজ ‘প্রাত সমুত্থায়’ হবে না?’ মেজমামা গম্ভীর হয়ে বলতো – ‘হবে, হবে’, আগে কিছু কর্তব্য সারতে হবে।’
তা সেই সময় সকালে উঠে নিয়মিত গীতাপাঠ শুনে আমার মধ্যে কিছু হলেও বোধহয় দৈবিক প্রভাব এসেছিল।
মেজমামার বাতিক ছিল সব নতুন নতুন নাম দেওয়া। সবাই আমাকে যে নামে ডাকতো সেই ডাক নামে না ডেকে মেজমামা আমাকে ডাকতো – ‘নাড়ু’। মা বলতো ছোটবেলাতে নাকি বেশ গোলগাল ছিলাম, রং ও একটু পরিষ্কার ছিল। মেজমামা দেখে বলতো – একেবারে নারকেল নাড়ুর মত। আমার দিদি চানের সময় ‘গঙ্গা, গঙ্গা’ বলতো তার নাম হল – ‘গঙ্গা’। ভুলেও মেজমামা আমাদের কোনদিন অন্য নামে ডাকতো না।
আমার মাসতুতো ভাই বাপ্পু জন্মের পর থেকেই ছিল খুব রোগাসোগা – নাম হল ‘পালোয়ান সিং’। হঠাৎ করে মেজমামার spoonerism এর শখ জাগলো। পালোয়ান সিং হয়ে গেল – ‘সালোয়ান পিং’। মেয়ে পান্নাবাঈ হয়ে গেল ‘বান্নাপাই’। ‘কোথায় যাবো?” হল “যোথায় কাবো?” সে এক কাণ্ড বটে।

এছাড়া আবার অভ্যাস ছিল ভালো নামে ডাকা। আমার মাসীর নাম ছোটবেলা থেকেই ‘বুলবুল’ বলে জানতাম। মেজমামা আবার ছোটবেলাতে হঠাৎ গম্ভীরভাবে ‘কৃষ্ণা’ বলে ডাক দিতে বেশ অবাক হয়েছিলাম মনে পড়ে। তারপর মাসী সাড়া দিতে ব্যাপারটা বোধগম্য হল। আমাদের ছোটমামা ও মাসীর কাছে শোনা যায় যে মেজমামা নাকি তাঁদের বেশ কড়া অভিভাবক ছিল। তবে সে ব্যাপরটা আমরা দেখিনি। শুধু ছেলে বুম্বা খুব দুষ্টুমি করলে বার কয়েক ‘পার্থসারথি’ বলে চড়া গলাতে হাঁক দিতে শুনেছি।
মামারবাড়ীতে প্রথম যে বিয়ের কথা আমার মনে পড়ে তা মেজমামার। আমি আমার দাদুর কোলে বসে মেজমামা ও মেজমামামীকে বকুলবাগান থেকে ল্যান্সডাউন রোডে আনতে গিয়েছিলাম। আসার পথে আবার কালীঘাটও ঘুরে এসেছি সেও মনে পড়ে। বেশীদিন নয়, – বছর বাহান্ন – তিপ্পান্ন হবে!

মেজমামার সূত্রে আমার একটি বিশেষ পত্রিকার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল খুব ছোটবেলাতেই। পত্রিকাটির নাম ‘সমতট’। অম্লান দত্তের ভাই অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত ছিলেন মেজমামার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরই সম্পাদনাতে প্রকাশিত হত ‘সমতট’। প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই আমার বাবা ছিলেন গ্রাহক। সেই সুবাদে আমার খুব ছোটবেলা থেকেই ভাল প্রবন্ধ পড়বার অভ্যাস হয়েছিল। আরো একটা মজার ব্যাপার ছিল। বিখ্যাত অধ্যাপক অরুণ কুমার বসুও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনি ‘ভাস্কর বসু’ ছদ্মনামে বেশ কিছু গান লিখেছিলেন। সুধীন দাশগুপ্ত সুরারোপিত ‘হিংসুটে দৈত্য’র ইনি ছিলেন গীতিকার। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি গম্ভীরভাবে বলতাম – ‘ওটা ওঁর ছদ্মনাম, আসল নাম অরুণ কুমার বসু।’ সকলেই বেশ আশ্চর্য হত আমি জানি দেখে। তবে ‘সমতটে’র প্রসিদ্ধির কথা আরো জেনেছিলাম পরে। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা বার করে ‘সমতট’। তাতে ছিল সত্যজিৎ রায় লিখিত একটি লেখা – ‘কমলবাবু’। তখনো কমলকুমার কে চিনিনা, কিন্তু সত্যজিৎ যে পত্রিকায় লেখেন তা নিশ্চয়ই নামী পত্রিকা। আমি ব্যাঙ্গালোরে আসার পরও বেশ কিছুদিন ‘সমতট’ সদস্য ছিলাম। এখনো কিছু সংখ্যা আছে আমার কাছে।

মামারবাড়ির বিখ্যাত কীর্তনে মেজমামা ছিল বড়মামার সহচর। বড়মামা ক্যাপ্টেন, মেজমামা – ভাইস ক্যাপ্টেন। দু’বছর আগে বড়মামার মৃত্যুর পর অবশ্য কীর্তনে বেশ ভাঁটাই পড়ে গেল।
মেজমামার সপ্রতিভতা ছিল চোখে পড়ার মত। আমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হত ভালোই। তবে মেজমামা বেশ মজাই পেত মনে হয়। মেজমামার অফিসের নাটক হবে, রবীন্দ্রসদন বা স্টার থিয়েটারে। এত বড় হলে? মেজমামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নার্ভাস লাগছে না?” মেজমামা মুচকি হেসে বলল, “আমার লাগছে না। তবে যারা দেখতে আসবে তাদের লাগতে পারে!” বোঝ কাণ্ড! আমার বিয়ের সময় অবশ্য মেজমামার এই সপ্রতিভতা দারুণ মজার সৃষ্টি করেছিল। সেটা একটু সবিস্তারে বলা যেতে পারে।
আমাদের রাজপুরে বাড়ির পিছনেই একটি মনোরম বাগান আছে। সেখানে শীতে সব্বাই মিলে খুব চমৎকার পিকনিক হত। আশির দশকের শেষের দিকে আমার বাবার হঠাৎ খেয়াল হল সেখানে একটি ছোট ঘর ও বাথরুম করলে মন্দ হয় না। তা করা হল। বাবা মাঝে মাঝে সেখানে থাকতেন, আমি ছুটি ছাটাতে কলকাতা গেলেও মাঝে মাঝে সেখানে কাটাতাম। মেজমামার ভাষায় এটি নাকি ‘বাগানবাড়ি’। আমার বিয়ের সময় আমার দুই শালী ও অন্যান্য কিছু মেয়েদের সাজসজ্জা করার জন্য জায়গার দরকার। মেজমামা আমার পিসতুতো দাদা, বড়দাদাকে বললেন, “বাবুল, এদের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাও।” বলার ভঙ্গীতেও বেশ জমিদারী স্টাইল। বড়দাদা এগিয়ে এসে মুখ চাপা দেয়, “মেজমামা, এমন কথা বলবেন না, অনেক লোক আছে। এরকম ফুটফুটে মেয়েদের বাগানবাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথায় কে কী ভাববে?” মেজমামা অবাক – “কী ভাববে? আমাদের বাগানবাড়ি আছে লোককে জানাতে হবে না?” বড়দাদা আবার – “মেজমামা, আস্তে আস্তে! লোকে শুনে ফেললে খারাপ ভাবতে পারে।” মেজমামা তো বুঝতেই পারছে না সুন্দরী, তরুণী মেয়ে এবং বাগানবাড়ির কী খারাপ সম্পর্ক হতে পারে, – অন্যদিকে বড়দাদা সিরিয়াস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি দু’জনকে দেখে।
মেজমামার আর একটি ব্যাপারও ছিল খুব মজার।

আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই বা যাদবপুরে পড়ি তখন পরীক্ষার সময় মামারবাড়ি থাকতাম। মেজমামার তখন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্সির (CA) পরীক্ষা চলতো। এটা ছিল মেজমামার একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান। মেজমামা কোনদিনই সিরিয়াসলি নিত না, কিন্তু পরীক্ষা দিত। আমি সেসময় মামারবাড়ি থাকলে আমার কাজই ছিল মেজমামাকে মনিটর করা, কখন পড়ছে, কখন রেস্ট নিচ্ছে, কখন কাগজ পড়ছে, কখন বাজার করতে যাচ্ছে। অতিষ্ঠ করে তুলতাম – মেজমামা অবশ্য বিশেষ বিরক্ত হতনা। হেসেই বলতো – “আরে বাবা, এই বয়সে, সব কাজ সেরে, শরীর ঠিক রেখে, তবে পড়াশোনা করতে হয়।” ব্যাঙ্গালোরে এসে খবর পেলাম শেষমেশ মেজমামা পাশ করে গেছে। পরের বার দেখা হতেই আমি অভিনন্দন জানালাম। মেজমামা বিষণ্ণ –“এহে, সেই পরীক্ষার পড়াশোনার দিনগুলি বড় চমৎকার ছিল রে। আর রইল না!”
পরিণত বয়সেই, প্রায় সুস্থ শরীরেই মেজমামার প্রয়াণ ঘটেছে। তেমন কোন শারীরিক অসুস্থতার ভোগান্তি সহ্য করতে হয়নি। এটা খুব স্বস্তির। প্রিয়জনের কাছে সক্ষম, সবল মানুষদের স্মৃতি খুব উজ্জ্বল। সেটাই চিরন্তন থাকা উচিত।
মেজমামা অবশ্য যেখানেই থাক, গীতার কথামতোই চলাফেরা করবে। সেই গীতাপাঠ এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল –

অসাধারণ 🙏
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ।
LikeLike