দুর্গা দা / দুর্গাবাবু

দুদিন আগে রাজুর ফেসবুক পোস্টে দেখলাম –

“হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুলের শিক্ষক দুর্গাবাবু (দুর্গাপদ ভট্টাচার্য) প্রয়াত হয়েছেন। ছাত্রজীবনে যে-কজন শিক্ষকের স্নেহ সবচেয়ে বেশি করে পেয়েছি তাঁদের মধ্যে দুর্গাবাবু সম্ভবত একেবারে শীর্ষে থাকবেন। উনি ছিলেন শারীরশিক্ষার শিক্ষক (অন্য সাবজেক্টও চমৎকার পড়াতেন) ।“

মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে একরাশ স্মৃতিও ভীড় করে এল। ২০১৫ সালে যখন ‘হরিনাভি’ স্কুলের বইটা লেখার কথা হচ্ছে, তখনই রাজুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাজু, দুর্গা বাবু লিখবেন না? উনি তো হরিনাভির ছাত্র এবং শিক্ষক, সুতরাং অনেকটা সময় ধরে দেখেছেন।”

রাজু খুব দুঃখের সঙ্গে জানালো যে দুর্গাবাবু খুব মনঃকষ্টে আছেন, সম্ভবতঃ ওঁর পক্ষে আর লেখা সম্ভব হবে না। কারণ জেনে খুবই খারাপ লেগেছিল, কারণ দুর্গাবাবু বয়সে আমাদের চেয়ে খুব বেশী বড় হবেন না। ১৯৭৪ সালে, আমরা যখন ক্লাস এইট, তখন উনি স্কুলে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে যখন হরিনাভি স্কুলে ভর্তি হই তখন আমাদের স্পোর্টস টিচার ছিলেন জিতেন দত্ত। একদম দুর্দান্ত পেটানো চেহারা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, যাকে বলে হ্যান্ডসাম পুরুষ। তিনি ভালো ক্রিকেটও খেলতেন। স্পিন বল করতেন, ডান হাতে। আমরা বলতাম ভারতের বাঁহাতি স্পিনার বেদি আর আমাদের ডানহাতি স্পিনার জেডি (জিতেন দত্ত)। জিতেনবাবু আবার হিন্দিও পড়াতেন।

১৯৭৪ সালে জিতেনবাবু অন্য স্কুলে চাকরি পেয়ে ছেড়ে দিলেন। এলেন দুর্গাবাবু। সেইসময় আমাদের ক্লাসে অনেক ছেলেই ছিল হরিনাভি বা সুভাষগ্রামের। তারা তো তাদের প্রিয় দুর্গাদা কে যে কীকরে ‘বাবু’ আর ‘স্যর’ বলবে ভেবেই পায় না।

দুর্গাবাবু এসেই কিন্তু আমাদের সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তার পরের বছর আমরা নাইনে উঠলাম আর আমাদের পিটি, ওয়ার্ক এডুকেসন, সোসাল সার্ভিস ইত্যাদির সব দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলো দুর্গাবাবুর।

আমাদের স্কুলের টিচাররা খুব ভালো হলেও একটু বয়সে বড় ছিলেন, বন্ধু স্থানীয় ছিলেন একমাত্র আশিস চাকি। এরপরে পেলাম দুর্গাবাবুকে। খুব উপভোগ করেছি ওঁদের সান্নিধ্য। সেসময় সামনের মাঠে ফুটবল নিয়ে খেলা হত, আশিস বাবু আর দুর্গাবাবুও যোগ দিতেন আর মজা করতেন। ছেলেদের গোলে শট মারানো তো ছিলই, নিজেদের মধ্যেও বেশ একে অপরের পেছনে লাগতেন। আশিসবাবু একবার একটা দারুণ শট করে বললেন, ‘দেখলে দুর্গা?’ ব্যস, আমরাও দুর্গাবাবুকে আরো ভালো শট মেরে দেখানোর জন্য জোর করতাম। দুর্গাবাবুও আমাদের মন রাখতে রাজি হয়ে যেতেন।

এরপর আমাদের আবার সোসাল সার্ভিসের ফিল্ড ওয়ার্ক ছিল। সেখানেও দুর্গাবাবু। আমাদের নিয়ে হরিনাভি, সুভাষগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। আবার ঘোরার পর ওঁর বাড়িতে গিয়ে আবার বসে বিশ্রামও নিতাম।

আমাদের বাংলা পড়াতেন সতীপ্রসাদ মিশ্র। ‘ছাত্রধারা’ পড়াতে গিয়ে তিনি একবার দুর্গাবাবুর প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। সেই যে –

“রাজপথে  দেখা হলে                কেহ  যদি  গুরু  ব’লে / হাত   তুলে  করে  নমস্কার,

বলি  তবে  হাসি  মুখে —-   ‘বেঁচে  বর্তে  থাকো  সুখে ‘, স্পর্শ করি’  কেশগুলি  তার।”

দুর্গাদা যখন ১৯৭৪ সালে স্কুলে যোগ দেন, তাঁর বেশ কেশক্ষয় হয়ে গেছে। সতীবাবু বলেছিলেন, ‘জানিস, এই দুর্গা, যখন স্কুলে ভর্তি হল, আমার পরিষ্কার মনে আছে ওর একমাথা কোঁকড়ানো চুল ছিল। আর এখন দেখ – কেমন টাক পড়েছে? কোথায় যে ‘স্পর্শ করি’?”

আমরা সুযোগ পেয়েই সেকথা দুর্গাদাকে জানাই। তাঁর সে কী হাসি! একটু মাথায় হাতও দিয়েছিলেন সম্ভবতঃ।

আমি এবং আমার ভাইয়েরা  স্কুল ছেড়ে দেওয়ার বহু বছর পর আমার মাসতুতো ভাই হরিনাভি স্কুলে ভর্তি হয়। মাসীর কাছে শুনেছি, সেইসময়ও দুর্গাবাবু আমাদের খোঁজ নিতেন।

আমাদের সেই সুখকর স্কুলজীবনের নায়কদের একে একে প্রস্থান হচ্ছে। এটাই জীবনের নিয়ম হয়তো। কিন্তু তবুও আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s