কৈশোরের প্রেম – গহন স্বপন সঞ্চারিণী – ‘মণিদীপা’

প্রিয় চরিত্রের কথা আগেই বলা হয়ে গেছে, তিনি পুরুষ। কিন্তু এবারে বাংলা সাহিত্যে আমার প্রিয় নারী চরিত্রের কথা একটু বলা যাক। তখন সাতের দশক শেষ হয়ে আটে পা দিচ্ছে। আমরা তখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। আমি ও আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু সোমনাথ তখন একসঙ্গেই প্রায় হাবুডুবু খাচ্ছি।

বইমেলাতে আমি ও সোমনাথ

“দেশ” পত্রিকাতে প্রকাশিত হচ্ছে একই সঙ্গে দুই ধারাবাহিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মানবজমিন’।

‘মানবজমিন’ উপন্যাসটিতে বহু চরিত্রের ভিড় – দীপনাথ, শ্রীনাথ, মল্লিনাথ, সোমনাথ, শমিতা, বিলু, তাদের স্বামী –স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, তৃষার ভাই সরিৎ, দীপনাথের অফিসের বস বোসসাহেব, তাঁর স্ত্রী মনিদীপা, অন্য সহকর্মীরা, বিলুর প্রেমিক অরুণ, ইত্যাদি।

উপন্যাসের নায়ক দীপনাথের জীবনে ঝড় তুলেছে তার বসের স্ত্রী মনিদীপা। আর সেই ঝড় লেগেছে উপরে উল্লিখিত কিশোর থেকে যুবক হতে যাওয়া দুই কলেজ ছাত্রদের প্রাণেও।

উপন্যাসটি অনেকে পরবর্তী কালে পড়েছেন, কিন্তু সেই যে ধারাবাহিক ভাবে, একটু একটু করে প্রেমে পড়ার ঘটনা – আহা, সে যে কি চমৎকার,- তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সেই যে পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা –

অনন্ত দুপুরে
একটা ঘাস ফড়িং-এর পিছনে
এক একটা মাছরাঙার পিছনে
গোটা বাল্যকাল
কার্পাস তুলো ফুটেছে
সেইদিকে তাকিয়ে দুটো তিনটে শীত–বসন্ত।
এইভাবে তো শরীরের খাল–নালায়
চুঁইয়ে চুঁইয়ে
ভালোবাসার জল।
এইভাবে তো হৃদয়বিদারক
বোঝাপড়া।

মনে হয় একেবারে আমার মনের কথা। প্রথম তাদের দেখা হওয়াটাও ভারী অদ্ভুত। ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গনে’ – উত্তরবঙ্গে। দীপনাথের বাড়ি উত্তরবঙ্গে, সেখানেই সে দেখেছে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। এবারে দেখল তার ঝড়কে, তার চোখ দিয়ে আমরাও প্রথম দেখি মণিদীপাকে –
“ওপাশের স্টলে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। পিছন থেকেও নির্ভুলভাবে মিসেস বোসকে চিনতে পারে দীপ। ভদ্রমহিলা ইদানীং কিছু উগ্র হয়েছেন। পরনে ঢোলা প্যান্ট, আর গায়ে খুব আঁটোসাঁটো একটা লাল পুলওভার। গলায় জড়ানো কালো নকশাদার একটা স্কার্ফ। বব চুলের ওপর একটা মস্ত বেতের টুপি। কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই একটা অসম্ভব সুন্দর গন্ধ পায় দীপ। গন্ধটা মোহাচ্ছন্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।”

যতবারই দীপনাথ মণিদীপার সংস্পর্শে আসে, তার সতেজতা তাকে কিভাবে যেন মুগ্ধ করে ফেলে। তার মনে হয় সে এক হাই ভোল্টেজ তারের নিকটবর্তী হয়েছে, আর একটু কাছে গেলেই শক লাগবে। সে তার নিজের শ্বাসের পরিবর্তন টের পায়।  

বোসসাহেব দীপনাথকে পাঠান মণিদীপার ওপর নজর রাখতে, যাতে সে বেশী কেনাকাটা না করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই দীপনাথ ভেবেছিল মণিদীপা বড়লোক বাড়ির কোন উচ্ছল গৃহবধূ, বরের টাকা ওড়ানো ছাড়া যার আর কোন কাজ নেই। দীপনাথ ভীরু প্রকৃতির মানুষ, তার চোখে প্রথমে মনিদীপা ছিল একটি তথাকথিত বড়লোকের বয়ে যাওয়া, বখাটে বউ। শুধু খরচ করে, ফটফট করে ইংরেজি বলে, কোন গভীর চিন্তার লেশমাত্র নেই অথচ সে আবার কম্যুনিস্ট।

কিন্তু আস্তে আস্তে সে আবিষ্কার করে অন্য একটি দুঃখী মানুষকে।

মিসেস বোস অচিরেই হয়ে ওঠে মণিদীপা। মণিদীপা ক্রমশঃ ঢুকে পড়ে দীপনাথের মনের গভীর কোণে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও। মোহ ক্রমবর্ধমান।

তখন ‘দেশ’ ছিল সাপ্তাহিক, এক কিস্তিতে মণিদীপা থাকলে আবার পরের কিস্তিতে অন্যরা থাকবে। কিন্তু সেই বয়সে মনটা ছটফট করতো মণিদীপার জন্য সে কথা আর অস্বীকার করি কি করে?

সোমনাথের বাড়ি ‘দেশ’ আসতো বিকেলে, আমার বাড়িতে সকালে। আসার দিন কলেজে এসেই সোমনাথের প্রশ্ন থাকত, ‘এবারে কি মণিদীপা আছে? না শুনলে মন খারাপ হত। আর থাকলে আমি আমি আবার কিছু সংলাপ শুনিয়ে দিতাম। যেমন –

‘(স্নিগ্ধদেবের কথা শুনে) দীপ লক্ষ করে মণিদীপার চোখে স্বপ্নের সুদূর ফুটে উঠল।’

মণিদীপা যখন দীপনাথকে অবহেলা করে, কি এক তীব্র দুঃখ স্পর্শ করে আমাদের। আবার তৃষার কাছে যখন সে শোনে মণিদীপা বারবার তার খোঁজ করেছে, বুকের ভিতর কি এক অদ্ভুত শিরশিরানি, দীপের আবার আমাদেরও। 

এই জায়গাটাও মারাত্মক। একদিন বাসে করে ফিরছে দীপনাথ, বিয়ে সিজনে বেলফুলের মালার গন্ধের সৌরভ, বিষাদকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তার পকেটমার হয়ে যায়, বাড়ি ফেরার টাকা নেই। সে বোসসাহেবের বাড়ি যায়। মণিদীপার সঙ্গে অনেক কথা হয় তার, সে বুঝতে পারে এক এক অদ্ভুত বন্ধনে সে জড়িয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর মণিদীপা, কি করে একে বোস সাহেব ডিভোর্স করবে? মণিদীপা আবার তাকে শিউরে দিয়ে বলে, দীপের ভালোমানুষির একটা আলাদা এট্রাকশন আছে তার কাছে। সে বুঝতে পারে, আজকাল তার আর কোন প্রিয় চিন্তা নেই, মণিদীপার কথা ভাবা ছাড়া। উফফ, মণিদীপা তদ্দিনে আমাদেরও মন জুড়ে। মণিদীপার কাছ থেকে বাসভাড়ার জন্য আধুলি নিয়ে যায় দীপ। পরে একদিন ফোনে কথা বলার সময়, মণিদীপাকে দীপনাথ বলে সে ফেরত দেবে আধুলিটা। খুব অস্পষ্ট ভাবে মনিদীপা জিজ্ঞেস করে –‘উইথ লাভ?’

এরপর মণিদীপা দীপনাথের সঙ্গে তৃষার কাছে বেড়াতে যায়। তৃষা বোঝে, আদরের দেওরকে ঠাট্টা করে। তৃষাকে অনেকেরই খুব পছন্দ, কিন্তু আমার একটু রাগ আছে। সে কেন মণিদীপাকে ‘টেলিফোনের মত কালো’ বলবে? ‘যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’!

তৃষা এসে দীপকে বলে ঐ মেয়েটি কথায় কথায় দীপনাথের কথা জিজ্ঞেস করছে, ‘উনি কোথায়, উনি কি খাবেন, উনি যদি খান, তাহলে আমিও খাব’ ইত্যাদি!

আহা! সংলাপে শীর্ষেন্দুর দক্ষতা অপরিসীম, কিন্তু তাহলেও বারবার মনে হয় মণিদীপা আর দীপনাথের সংলাপে তিনি যেন নিজের সীমাকেও অতিক্রম করেছেন। বারে বারে!! মনে পরে শিলিগুড়ি থেকে ফোন এল মণিদীপার কাছে যখন সে নিজের কিছু করার কথা ভাবছে।

- ব্যাপারটা সিরিয়াস আমি একটা দোকান দিচ্ছি।
- কিসের দোকান? 
- পান বিড়ির!
- তাহলে আমি ভাল এডভাইস দিতে পারবো ----
- শুনুন আপনাকে কিন্তু আমার পার্টনার হতে হবে
- কিরকম পার্টনার? 
- পার্টনার আবার কিরকম হয়? ক্যাপিটাল ইনিভেস্টমেন্ট ফিফটি ফিফটি। 
- অর্থাৎ আপনি পান সাজবেন আর আমি বিড়ি বাঁধবো? 

উফফ! আমাদের বুকে এইসব সংলাপ যে কিরকম দোলা দিত তা বোঝাতে পারবো না।

যাঁরা এই কাহিনী ধারাবাহিকভাবে পড়েছেন, তাঁদের মনে থাকতে পারে সর্বশেষে আরো একটি পর্ব ছিল। সেটি হল, মণিদীপা খবর পেয়েছে দীপনাথ যে কোম্পানীর প্লেনে বিদেশ যাচ্ছে, সেই কোম্পানীর একটি প্লেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। মণিদীপা ছুটে আসে তৃষার কাছে, প্রবল কষ্ট নিয়ে। তখনই সে প্রায় ধরা দেয় তৃষার কাছে। তৃষা তার আকুতি দেখে কষ্ট পায়, তাকে আশ্বস্ত করে যে দীপনাথ ঠিকমতো পৌঁছে গেছে। চিন্তার কিছু নেই। তৃষা মণিদীপাকে ফেরৎ পাঠায় বোসসাহেবের কাছে।

অসাধারণ উপন্যাসের এই শেষপর্ব আমার একদম ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল, বড্ড আটপৌরে হয়ে গেল যেন! সেই বিমূর্ততাটা আর রইল না। এটি কেন লিখলেন লেখক?

তার আগের পর্ব শেষ হয়েছিল এভাবে। বোসসাহেবের বাড়িতে ফেয়ারওয়েল ডিনারের নেমন্তন্ন! বোসসাহেব জানিয়েছেন, দীপা নিজে রাঁধবে। সেখান থেকে ফিরেই পরের দিন দীপনাথ কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছে, হয়তো বরাবরের মতই। কিন্তু এই আহ্বানেই তার মন কেঁপে ওঠে – ‘কাল মণিদীপার সঙ্গে দেখা হবে, কাল মণিদীপার সঙ্গে দেখা হবে, কাল মণিদীপার সঙ্গে—’

একদম শেষে এসে দীপনাথ চলে যাবে দেশের বাইরে। শেষ দেখা মণিদীপার সঙ্গে। এসে দেখে মণিদীপা নিজে রান্না করছে। দেখা হয় তার মণিদীপার সঙ্গে – গাঢ় চোখে মণিদীপা জিজ্ঞেস করে –

- আমেরিকাতে না গেলেও দূরেই তো ছিলেন, আ থাউজ্যান্ড লাইটইয়ার্স!
- দূরই ভাল।
- ভুলে যাবেন?
-সব কি ভোলা যায়? বোসকে কে দেখবেন, উনি হেল্পলেস।
- আমিও হেল্পলেস।’

আবার পূর্ণেন্দু পত্রী মনে পড়ে –

‘অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।’

একদম শেষে –

“উত্তরে এই অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। পাহাড়ও বহু বহু দূর। --------দুঃখ, দৈন্য, দুর্দশা, অপমান, স্মৃতিভার থেকে শীতল মুক্তি! --   কাগজের ন্যাপকিনটা হাতে ধরা ছিল দীপনাথের। সন্তর্পনে সেইটা তুলে দুচোখের কোল মুছে নিল।”

যখন পেপার ন্যাপকিনে চোখ মুছছিল, তার নিশ্চয় চোখে ভেসে উঠেছিল মণিদীপা। নিশ্চয়, কারণ নারী শরীরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ভুল করে সে যখন অন্য একটি নারীর (বীথি) সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছিল, তার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল মণিদীপা। আসলে বীথির কাছে গিয়েই সে বুঝতে পারে সে আসলে কতখানি ভালোবাসে মণিদীপাকে।

মণিদীপাও জানে তার সর্বনাশের মূল দীপনাথ। একবার সে বলেও ফেলেছিল, কিন্তু দীপনাথ সাহস করেনি। তাও জানে সে দীপনাথ, একমাত্র দীপনাথই এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপনজন।

আমারে নাহয় না জানো’ –

মণিদীপার সঙ্গে ফিরে আসার সময় আর দেখা হয়না, –

দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে, কাছে কেন লাজে লাজানো, সেই ভাল সেই ভাল’!!

সত্যিই! বড্ড ভালো, মণিদীপা।

ভাল কিন্তু লেখকও। তাই তিনি আমার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমি জানাইনি, কিন্তু তিনি কি আর তাঁর অনুরাগী পাঠকের কথা ধরতে পারেননি? তাই গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় বাদ গিয়েছিল ধারাবাহিকের শেষ পর্বটি।

‘মানবজমিন’ আদৌ পতিত নয়। তার প্রত্যেক জায়গাতেই সোনার ফসল ফলিয়েছেন লেখক। তিনি বাংলার সাহিত্য সম্রাট – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s