বাঙালীর প্রাক্তন উপনিবেশে – মনোরম সাতদিন

(আজ, ১৭ইমে, ২০২২! বুদ্ধ পূর্ণিমা। ছুটি থাকলেও ভারতে বৌদ্ধদের সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু একটি পার্শ্ববর্তী দেশে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাঁরাই সংখ্যাগুরু।
দেশটির সময় আর ভারতের সময় কাঁটায় কাঁটায় এক। আজ সেই দেশটি, শ্রীলঙ্কা, ভীষণভাবে সমস্যা জর্জরিত।
২০১৫ সালে আমরা যখন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তেমন কিছুই টের পাইনি। সেই নিয়ে লিখেছিলাম এক ভ্রমণ বৃত্তান্ত। সেটি লেখার পিছনে তাগিদ দিয়েছিলেন শেখরবাবু। তাদের প্রকাশিত শারদীয় যুগ পত্রিকাতে খুব সুন্দর করে ছেপেছিলেন অরিজিৎ ও অভিষেক।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা এই তিনজনকে। শেখরবাবু লেখাটির একটি সুন্দর নামও দিয়েছিলেন – “বাঙালীর প্রাক্তন উপনিবেশে – মনোরম সাতদিন”!
তবে মনে হয় অনলাইনে লেখাটি আরো কিছু পাঠকের দরবারে পৌঁছতে পারবে।
আশা করি আমাদের প্রতিবেশীর এই সংকট অচিরেই কেটে যাবে এবং আবার আগের মতই ভ্রমণার্থীরা দলে দলে সেখানে ভিড় করবেন।
)

– প্রায় কেরালারই মত তো? বেশি খরচ করে যাওয়ার দরকার কি?

– ওরে বাবা শ্রীলঙ্কা আলাদা ব্যাপার। আমাদের সাহিত্যেও কি রোমান্টিক উল্লেখ!

– কোথায় আবার? ও সেই রাবণের ‘লঙ্কা’?

– না! জীবনানন্দ সেন! বিখ্যাত কবিতা –

– ওহো!! বনলতা সেন?

– একদম –

"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;
"

দক্ষিণের প্রবাসী বাঙালী পরিবারেরা শ্রীলংকা যাত্রা করার আগে এরকম আলোচনা খুবই স্বাভাবিক।

‘অতি দর্পে হতা লঙ্কা’ – পড়ে আসছি তো সেই ছোটবেলা থেকেই। রাবণ রাজার বাড় বেড়েছিল বিস্তর আর তার ফলস্বরূপ, মন্দোদরীর বিলাপ-‘হায় নাথ নিজ কর্মফলে মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলা আপনি।’

আবার কিছুকাল আগে অবধি শ্রীলঙ্কা মানেই তো ছিল সন্ত্রাসবাদ আর যুদ্ধ!! শ্রীলঙ্কার উত্তরার্ধ জর্জরিত হয়েছে প্রায় গত তিন দশক ধরে। অবশেষে গত বছর পাঁচ-ছয় শ্রীলঙ্কাতে শান্তি ফিরে এসেছে। দলে দলে পর্যটকরা পাড়ি দিচ্ছেন। বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই তো ঘুরে এলেন, আমরাও তাই চললাম সেই রাবণের দেশে।
ছন্দের যাদুকর অবশ্য আমাদের অনেক সুন্দর বিবরণ দিয়েছিলেন – ঐতিহাসিক ভাবে গর্বভরে জানিয়েছিলেন-

“আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ / হেলায় লঙ্কা করিয়া জয় /
সিংহল নামে রেখে গেছে / নিজ শৌর্যের পরিচয়” !!

আর ভৌগোলিক ভাবে–

"ঐ সিন্ধুর টিপ / সিংহল দ্বীপ / কাঞ্চনময় দেশ!
ঐ চন্দন যার অঙ্গের বাস / তাম্বুল বন কেশ!"

খোদ রবিঠাকুরও যে বিবরণ দিয়েছে ‘তাসের দেশে’র সেই যাত্রার –

“নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ / প্রবাল দিয়ে ঘেরা ,
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে / সাগর - বিহঙ্গরা ।
নারিকেলের শাখে শাখে / ঝোড়ো বাতাস কেবল ডাকে ,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে / বইছে নগনদী—
সোনার রেণু আনব ভরি / সেথায় নামি যদি”।

শুনেই মনে হয় না “সোনার রেণু আনব ভরি” বলতে যেদেশের বা দ্বীপের কথা বলা হচ্ছে তা সেই ‘কাঞ্চনময় দেশ’ই। তাই শেষ মেশ অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর আমরা আর না বলে পারলাম না – ‘যাবই, আমরা যাবই’!

         আমদের গাইড প্রসাদ অবশ্য বিজয়সিংহের ব্যাপারে একটু ভিন্ন মত পোষণ করে। তাঁর ধারনা বিজয়সিংহ তাঁর দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েই শ্রীলঙ্কাতে পাড়ি দিয়েছিলেন। একথার সত্যতা নির্ধারণও করেছি, আসছি সে প্রসঙ্গে।

         আমরা বেড়ানোর জন্য বেছেছিলাম যে জায়গাগুলি তা সবই শ্রীলঙ্কার দক্ষিণার্ধে। আমাদের যাত্রাপথ ছিল –

কলম্বো – ডাম্বুলা – ক্যান্ডি- নুয়ারা-এলিয়া – ইয়ালা  সাফারি – গ্যালে – বেনটোটা- কলম্বো” – যাত্রাপথটি নীচের ছবিতে ধরা আছে।

শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের বিমান যখন আমাদের কলম্বো তে পৌঁছে দিল তখন রাত দশটা। পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশের সঙ্গে ভারতীয় সময় কাঁটায় কাঁটায় মেলে –  আর তা হল শ্রীলঙ্কা। কাজেই সময়ের বিন্দুমাত্র হেরফের নেই। 

এয়ারপোর্টের শ্যামলিমা দেখে নিজের ‘তালীবনশ্যাম’ বঙ্গদেশ কে মনে পড়া বিচিত্র নয়। আবহাওয়া ও বেশ গরম আর সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় বাতাসে আর্দ্রতা বেশ ভাল পরিমাণেই উপস্থিত।

রাত্রে কলম্বো হোটেলে থেকে পরদিনই সকালে আমরা বার হলাম ডাম্বুলার উদ্দেশে। আমাদের পথপ্রদর্শক শ্রী প্রসাদ। হাসিখুশী ছেলেটি! ভালো লাগল জেনে যে শ্রীলঙ্কায় রীতিমত ট্যুরিজম এর পাঠ সম্পূর্ণ করে তবেই সে গাইড হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী একটি দেশে এইরকম সচেতনতা দেখে একটু আনন্দের সঙ্গে আপশোষও হল! ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গতে এইরকম সচেতনতা প্রত্যাশা করা কি খুবই বেশী কিছু! ঐতিহ্য বা দেখবার জায়গা আমাদের দেশে কম কিছু নয়। শ্রীলঙ্কার পথে ঘাটে যানবাহন চলাচল রীতিমত শৃঙ্খলাবদ্ধ। প্রসাদ জানালো, নিয়মভঙ্গের শাস্তি এখানে জরিমানা নয়, জেল। ফলে চালকরা খুব তটস্থ।

পথে দেখলাম পিনাওয়ালাতে হাতিদের অনাথাশ্রম। হ্যাঁ, ঠিকই।  যে সমস্ত শিশু হাতিদের তাদের মায়েরা ভরণপোষণ করতে পারে না, তাদের জন্যই শ্রীলঙ্কার সরকারের এই রাজকীয় ব্যবস্থা।  তা ‘হাতির খোরাক’ জোগানো তো মুখের কথা নয়,  হাতিদেরই বা দোষ কি! হাতিদের খাওয়ানোর খুব ঘটা। দেশী-বিদেশী ভ্রমণার্থীদের খুব ভিড় লেগে যায়। নদীর জলে হাতিদের ঘোরাঘুরি খুবই মনোহর। ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী এখানে অনধিক নব্বইটি হাতি এবং তাদের দেখাশোনার জন্য প্রায় পঞ্চাশ মাহুত আছে।  এরপরেতে আমরা পিনাওয়ালাতে লাঞ্চ সেরে রওয়ানা দিলাম ডামবুলার উদ্দেশে। সেখানেই  রাত্রিবাস।

পরের দিন আবার যাত্রা। এইবার লক্ষ্য ‘সিগিরিয়া’!

সিগিরিয়ার অবস্থান বর্তমান শ্রীলঙ্কার মাটেলা জেলায়। সাধারণ কথায় এটিকে পাহাড় বলা হলেও ভূতত্ত্ববিদরা একে ডাকেন ইন্সেলবার্গ বলে। ইন্সেলবার্গ বলতে মূলত বিশালাকার, বিচ্ছিন্ন একটি পাথরকে বোঝায়। আবার স্থানীয়দের মধ্যে এটি সিংহপাথর নামেই পরিচিত। এই সিংহপাথরটির উচ্চতা প্রায় ২০০ মিটারের কাছাকাছি। রাজা প্রথম কশ্যপ (৪৭৩ – ৪৯৫ খ্রীষ্টাব্দ) সিংহাসনে আরোহণের পর সিলনের নতুন রাজধানী নির্বাচন করেন সিগিরিয়াকে।

প্রাচীন এ রাজধানীটির বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সামান্য যে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়, এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো কশ্যপের রাজপ্রাসাদের কিছু অংশ। রাজা কশ্যপের আমলে এটি সজ্জিত করা হয়েছিল অপরূপ এক সাজে। একে তো প্রায় ২০০ মিটার উঁচুতে রাজপ্রাসাদ আবার পুরো পাথরের চারপাশ ভরিয়ে ফেলা হয়েছিল রঙিন দেয়ালচিত্রে। এ ছাড়া এ পাথরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে কিছু কবিতা। যেগুলোকে সিংহলি ভাষার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়। প্রাসাদ ও দুর্গ- এ দুটি হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এটি। প্রাসাদে প্রবেশের জন্য সিংহাকৃতির বিশাল একটি প্রবেশপথও নির্মাণ করেছিলেন কশ্যপ। মূলত এই প্রবেশপথটির কারণেই পাথরটি সিংহপাথর নামে পরিচিতি পায়।

৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে কশ্যপের পতন ঘটলে সিলনের রাজধানী অনুরাধাপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এটি বৌদ্ধ মঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষের দিকে এসে এটি দৃষ্টি কাড়তে শুরু করে প্রত্নতত্ত্ববিদদের। প্রাচীন নগর পরিকল্পনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ নিদর্শনটিকে ১৯৮২ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।

সিগিরিয়াতে একটি খুব সুন্দর মিউজিয়ামও আছে। জাপান সরকারের উপহার শ্রীলঙ্কাকে। ২০০৯ সালে এই মিউজিয়মটির উদবোধন করা হয়।

সিগিরিয়া দেখে আমরা রওয়ানা হয়ে রাত্রে পৌঁছলাম শ্রীলঙ্কার শৈলশহর ক্যান্ডিতে, সেখানেই রাত্রিবাস।

এখানে পৌঁছেই বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। এতদিন ঘোরাঘুরি হচ্ছিল বেশ গরমের মধ্যেই। দুটি তরুণ সদস্য ছাড়া আমাদের দলের সকলেই ‘পঞ্চাশোর্ধে’। কাজেই গরমে আমরা বেশ পরিশ্রান্ত বোধ করছিলাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ক্যান্ডির সন্ধ্যাটি মনোরম ছিল। ক্যান্ডিতে আমরা শ্রীলঙ্কার একটি সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছিলাম।

মনে করা যেতে পারে যে খোদ রবিঠাকুর ও শ্রীলঙ্কাতে এসেছিলেন তাঁর দল নিয়ে। সেটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ বিদেশ ভ্রমণ, ১৯৩৪ সালে। কলম্বো, পানাহুয়া, গ্যালে, মাতারু, ক্যান্ডিতে এসে দেখলেন প্রাচীন লোকনৃত্য ও মুখোশনৃত্য। ক্যান্ডিতে যে উদ্দাম নাচ দেখেছিলেন – তাই নিয়ে লিখেছেন,

"সিংহলে সেই দেখেছিলেম ক্যান্ডিদলের নাচ;
শিকড়গুলোর শিকড় ছিঁড়ে যেন শালের গাছ"

এইবার আমরা চলেছি নুয়ারা – এলিয়ার পথে। নামটি আমাদের খুব পরিচিত নয়, কিন্তু যদি বলি অশোকবন, সবাই একসঙ্গে বলে উঠবেন ‘সেই সীতা যেখানে বন্দী ছিল’! কতকটা তাই বটে। তবে এই শহরের অন্য নাম কিন্তু “ছোট্ট ইংল্যান্ড”! ‘চিরবসন্ত’ বিরাজমান,  আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত এই শহরটি। ধারে কাছেই আছে সুন্দর সব ভিউ পয়েন্ট, আরো আছে সুদর্শন চা বাগান। আমাদের মন একেবারে কেড়ে নিয়েছিল এই শহর তার আশে পাশের চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী। মাত্র একদিনে মন ভরে না, জায়গাটি এতই উপভোগ্য। বারান্দা থেকে দেখলে মনে হয় –

‘ঐ আঁকা বাঁকা পথ বুঝি যায় সুদূরে’!

নুয়ারা এলিয়াতে আমাদের সীতা মন্দির দর্শন হল। হনুমানের পায়ের ছাপ ও দেখা গেল। অবশ্য এর কতটা ইতিহাস, কতটুকু গল্পগাথা তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকা খুব স্বাভাবিক। এর পথে  পথে ঘুরতেই খুব ভালো লাগে। সেখানকার ছোট্ট সুন্দর রেল স্টেশন, গলফ কোর্স, চার্চ, আঁকা বাঁকা, উঁচু নীচু পাহাড়ী পথ, বিভিন্ন ইউরোপীয় শৈলীর হোটেল গুলিও বড় আকর্ষণ। যে জায়গাতে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম, তার সৌন্দর্য এককথায় “রুদ্ধশ্বাস”! একটি ছোট্ট চা- কারখানাতে গিয়ে দেখলাম চা তৈরীর বিচিত্র কলাকৌশল। নিজের হাতে চা পরীক্ষা করে সেখানে চা পানের বিরতিও হল।

তবে এখানেই একটি বেশ মজা হয়েছিল আমাদের, হোটেলটি অন্য হোটেলগুলির তুলনাতে একটু নিরেস। এটির নাম ছিল ‘ফরেস্ট লজ’। আবার এখানেই আমাদের মতই আর একটি বাঙালী দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁরাও কলকাতা থেকে দলবল নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। জায়গাটি বেশ শুনশান।

কাঁঠাল ফল হিসেবে উপাদেয় হলেও গন্ধটি বেশ অসহ্য। শ্রীলঙ্কাতেও এরকম এক ফল আছে, তার নাম – ‘দুরিয়ান’। ইনি কাঁঠালের পিতামহ। এই হোটেলেই কোন ঘরে সম্ভবত ছিল! একটু পচন ও ধরেছিল। উফফ, কি সাঙ্ঘাতিক প্রাণহরা গন্ধ! আমরা আর সেই অন্য বাঙালী দল, একেবারে  নাজেহাল। হোটেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিল। কিন্তু তাতেও কি? ‘প্রহর হল শেষ’ – কিন্তু আবেশ জুড়ে রইল, ম,ম করছে হোটেলের ঘর। পরে অন্য দু এক জায়গায় দেখেছি হোটেলে ‘দুরিয়ান নিষিদ্ধ’ গোছের নির্দেশ। কিন্তু এখন! এমন মনোরম জায়গাতে – একি দুর্দশা!

নুয়ারা এলিয়ার পরেই আমাদের গন্তব্য ছিল ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক। এতদিন আমরা প্রত্যেক জায়গাতেই মাত্র একরাতের বাস ছিল, একটু ক্লান্তিকর হয়ে যাচ্ছিল। ইয়ালাতে তাই আমাদের দুই রাতের থাকার বন্দোবস্ত ছিল। এইখানে থাকার জায়গাটি ছিল ছোট ছোট কটেজ। প্রত্যেকের যেন এক-একটি নিজস্ব বাড়ী, সব কাছাকাছি। এই ঘরোয়া, গ্রাম্য পরিবেশে আমরা দু রাত্তির ছিলাম, ফলে একটু বিশ্রামও হয়েছিল। এখানে কেমন যেন আমাদের মফস্বলের পাড়া পাড়া অনুভূতি। দ্বিপ্রাহরিক স্নানও সারা গেল এখানকার পুকুরে, যাকে এরা বলে Swimming Pool!

সক্কাল সক্কাল উঠে ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কে আমাদের সাফারি শুরু হয়েছিল। কিন্তু রীতিমতো হতাশা। সেইরকম আশাপ্রদ জন্তু জানোয়ার খুব কিছু চোখে পড়ল না। হরেক রকম পাখির সম্ভার ছিল, হাতীর পাল ও ছিল, আর ছিল কুমীর।  ন্যাশনাল পার্কের প্রত্যাশা তাতে যে খুব মিটেছে তা বলা যাবেনা। দর্শনীর হারও বেশ চড়া। আমি সকলকে বলবো এটি এড়িয়ে যেতে।

ইয়ালা পার্কের সমুদ্রের দিকে অবস্থিত একটি বাড়িতে স্মৃতি ফলক লাগানো আছে। ২০০৫ সালে সুনামিতে শ্রীলঙ্কাতে প্রভূত ক্ষয় ক্ষতি হয়। সেই সময় এই পুরো বাড়িটিই তার অধিবাসীসহ ভেসে গিয়েছিল। এটা দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের সে প্রকৃতির ভয়াবহতার কথা মনে এসেছিল।

ইয়ালা থেকে আমরা গেলাম গ্যালে হয়ে বেনটোটা। গ্যালে শহরটি একেবারে সমুদ্রতীরবর্তী।

ভারত যখন টেস্ট খেলতে শ্রীলঙ্কা যায়, গ্যালেতে টেস্ট থাকেই। যাওয়ার পথে স্টেডিয়ামটিও দেখে ফেললাম।

গ্যালে থেকে চললাম আমাদের শেষ দর্শনীয় স্থান, ‘বেনটোটা’! গ্যালে আর কলম্বোর প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান এই উপকূলবর্তী শহরটির। অপরূপ সৌন্দর্যময়ী এই শহরের তটরেখা। হোটেল এ যেতে গিয়ে আমাদের স্টীমার বোটের সাহায্য নিতে হল। হোটেলটিও এক্কেবারে যাকে বলে – ‘বিচ হোটেল’। হোটেলের পিছনেই আদিগন্ত প্রসারিত সমুদ্র। সমুদ্রটি অবশ্য খুব শান্ত নয়, বেশ কিছু জায়গাতেই সতর্কবাণী দেওয়া রয়েছে – ‘ নিরাপদ নহে’!!

এখান থেকেই বিদায় নিল আমাদের গাইড প্রসাদ। হাসিখুশি ছেলেটি আমাদের সকলের তো মন জয় করেইছিল, আমাদের দলের দুই তরুণ সদস্যের সে একেবারে প্রাণের দোসর হয়ে উঠেছিল। তাকে বিদায় দিতে গিয়েই আমাদের মনে হল,

“এখন আমার সময় হল /  যাবার দুয়ার খোল খোল”

এই কদিনেই বেশ আপন হয়ে উঠেছিলাম আমরা তার কাছে।

তবে এই শেষ পর্যায়েই বলে ফেলা যাক প্রসাদের বর্ণিত বিজয়সিংহ উপাখ্যান।

প্রসাদ আমাদের জানিয়েছিল যে আমরা বিজয়সিংহকে নিয়ে খুব লাফালাফি করি, জানি কি যে বিজয়সিংহ কিন্তু আসলে তার জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল? পরে সে হয়ে ওঠে এক বীর যোদ্ধা। তখন আমার কাছে এই ব্যাপারটি খুবই অবাক লেগেছিল, কারণ সত্যিই জানতাম না। দ্বিজেন্দ্রলাল ও লিখেছিলেন,

"একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়,
একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।"

কিন্তু প্রসাদের এই কথাটি আমার মনে থেকে গেছিল। দেশে ফিরেই একটু তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেল প্রসাদবাবু ঠিকই বলেছিলেন, তাঁর ভ্রমণশিক্ষার পঠন-পাঠন খুবই সুচারু। যা জানা গেল তা এইরকম।

সময়কাল খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। বাংলার রাঢ় অঞ্চলে্র রাজা ছিলেন সিংহসিবলী, তাঁর রাজধানী ছিল সিংহপুর, অধুনা সিঙ্গুর।  বিজয়সিংহ ছিলেন রাজা সিংহসিবলীর বড় ছেলে। ভয়ংকর অত্যাচারী ছিলেন, সঙ্গে আবার জুটে গেছিল একদল অপোগণ্ড ভক্ত। তাদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে প্রজারা রাজার দরবারে এসে নালিশ করতো, মৃত্যুদণ্ড অবধি প্রার্থনা করতো।  রাজাও আর সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে নির্বাসনে পাঠালেন। বিজয় আর তার সাতশো অনুচরের মাথা অর্ধেক মুড়িয়ে তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়ে সমেত জাহাজে তুলে দিলেন। তবে রাজা তিনটি জাহাজে তাঁর অনুগত, পারদর্শী নাবিকদের পাঠিয়েছিলেন। শোনা যায় সেই সময় নৌবিদ্যায় বাঙালীদের বেশ দখল ছিল। তাম্রলিপ্ত বা অধুনা তমলুক বন্দর হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল।

সেই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকেই নির্বাসনের পথে রওয়ানা দিলেন তাঁরা। দুর্ভাগ্যবশত জাহাজ সমুদ্রে ঝড়ে পড়ল। এইবার বিজয়ের টনক নড়লো। জাহাজ যখন সাগরে ঝড়ে পড়লো তখন তিনি ও তাঁর দলবল সামলাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে বেশ পাকা হয়ে উঠলেন সকলেই। তারপর সাগর ঠেলে বিজয়ের জাহাজ এসে ভিড়ল শ্রীলঙ্কার উপকূলে তাম্রপর্ণীতে।

শ্রীলঙ্কা দেখে বিজয় ও তাঁর বন্ধুরা মুগ্ধ! তারপরে তিনি মাত্র সাতশ সেনা নিয়ে লঙ্কা জয় করলেন। প্রবল পরাক্রমে স্থাপিত হল বাংলার তথা ভারতের প্রথম উপনিবেশ। শ্রীলঙ্কার নাম পাল্টে হল সিংহল, ‘সিংহ’ বংশের গরিমা রাখতে।

তাঁদের এই রাজ্য শাসন চলেছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। প্রমাণস্বরূপ, সিংহলী ভাষাতেও খুব বাংলা ভাষার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটির প্রথম পর্বে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

বিজয়কে আমরা যতই ‘দুষ্টু ছেলে’ বা ‘বিতাড়িত’ বা ‘অত্যাচারী’ বলি না কেন, দীনেশচন্দ্র কিন্তু তাঁর প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। তাঁকে ছন্নছাড়া, বিদ্রোহী রাজকুমার নামে অভিহিত করেছেন। বলছেন, রবিবাবু এখন এইরকম দুরন্ত ছেলের খোঁজ পাচ্ছেন না বলেই তো বাংলার মায়েদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন – ‘দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া করে’!  কি কাণ্ড!

তবে সিংহলীরা আর বাঙালীরা যে ‘তুতো’ ভাই তা বেশ সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণ করে ছেড়েছেন ‘সেন মহাশয়’। প্রায় হাজার দুয়েক বাংলা আর সিংহলী শব্দে মিল খুঁজে বার করেছেন।

আরেকটা ব্যাপারও বেশ মজার। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতে ও রবিঠাকুরের ছোঁয়া আছে। অবসর ওয়েবজাইনে এ বিষয়ে শ্রী সুজন দাশগুপ্ত লিখেছেন,

শ্রীলঙ্কা থেকে আনন্দ সামারাকুন নামে একটি ছাত্র বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন পড়াশুনো করতে এবং অল্পদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। আনন্দের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ নাকি বাংলায় “নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানটি লিখে সুর করে আনন্দকে দেন। আনন্দ দেশে ফিরে গিয়ে এটিকে সিংহলীতে অনুবাদ করে রেকর্ড করেন। পরে ১৯৫১ সালে গানটি শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। বিস্তারিত পড়া যেতে পারে

http://www.abasar.net/UNIbibidh_srilanka.htm

সেই বাঙালী বিজয়ের দেশ ভ্রমণ শেষ হল বেনটোটার সমুদ্রতীরেই।  এবার কলম্বোর পথে পাড়ি। কিছু কেনাকাটার পর আবার ‘ঘর ওয়াপসি’র পালা!!

তথ্যঋণ –

5 thoughts on “বাঙালীর প্রাক্তন উপনিবেশে – মনোরম সাতদিন

  1. এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। মানসভ্রমণ তো হলই, সাথে ইতিসাসেও সমৃদ্ধ হলাম। দারুণ লাগলো দাদা।

    Liked by 1 person

  2. ভারী সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী । তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি থেকে সমৃদ্ধ হলাম শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে অনেক না জানা বিষয়ে।

    Liked by 1 person

Leave a comment