সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষে তাঁর ওপর করা অনীক দত্তের ছবি ‘অপরাজিত’ দেখার সৌভাগ্য হল। ব্যাঙ্গালোরে অনেক বাংলা সিনেমা আসে আবার অনেক সিনেমাই আসে না। ফলে কিঞ্চিৎ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। খোঁজ পেতেই আর দেরি করিনি। এই ছবিটি বড় পর্দায় দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। এত কিছু শুনেওছি ছবিটি সম্পর্কে, বড় পর্দায় এই সিনেমা দেখার আলাদা আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার কোন ইচ্ছেই ছিল না।
বস্তুতঃ আমার সত্যজিৎ প্রেম প্রায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আমার বাবা ও কাকা, দুজনেই ছিলেন অসম্ভব সত্যজিৎ ভক্ত। এছাড়া ‘পথের পাঁচালী’র বিশ্বজয় তাঁদের নিজের চোখে দেখা। তাঁদের কাছে এই গল্প গুলি শুনেই বড় হয়েছি। এছাড়া নিজের আগ্রহ থাকার ফলে সত্যজিৎ রচিত এবং অন্যান্য বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের সুবাদে ঘটনাগুলি জানা ছিল। সেজন্য এই ছবি দেখার আগ্রহ থাকলেও আশঙ্কা কিছু কম ছিল না। সত্যি কথা সিনেমাটি দেখে কিন্তু সেই আশঙ্কার অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেজন্য আমি খুশি এবং পরিচালক অনীক দত্তের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
একটি বিষয় প্রথম থেকেই আমার মনোগ্রাহী ছিল না। সত্যজিৎ এবং অন্যান্য কুশীলবদের নাম পরিবর্তন করা আমার কাছে খুব সুবিবেচনার পরিচয় বলে মনে হয়নি, কিছুদিন আগেই দেখেছি -“১৯৮৩” নামক ছবিটি। তাতে কপিল সহ সব খেলোয়াড়দের আসল নামই ছিল। তাতে ছবিটি ভীষণভাবে উপভোগ্য হয়েছিল।
তবে ছবিটি দেখতে গিয়ে এই তফাৎ অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলে গিয়ে বেশ উপভোগ্য হয়েছে। বেশ মজা লাগছিল ছবির নামের পিছনে আসল নামগুলিকে আবিষ্কার করতে। ছবি তৈরির ব্যাপারটির মধ্যে আমরা বেশ ঢুকে যেতে পারছিলাম। মূল চরিত্রে জীতু কামালকে দেখে প্রায় সত্যজিতের উপস্থিতি অনুভব করা গেছে। বিশেষ করে সিগারেট ধরা, চিন্তাশীল মুহূর্তগুলি, অঙ্কনরত অবস্থায় নিবিড় মনঃসংযোগী বা আলোচনারত অবস্থায় জীতুকে দেখে আমরা সেই সময়টিকে বেশ ভালমতই অনুভব করতে পেরেছি।

যেমন ধরা যাক পাশের ছবিটিতে। অপরাজিত (সত্যজিৎ) এবং তাঁর চিত্রগ্রাহক সুবীর মিত্র (সুব্রত মিত্র) কে আউটডোরে ক্যামেরা ও সরঞ্জামসহ আলোচনারত দেখে আমাদের প্রায় একেবারে পুরনো শোনা গল্প এবং ছবিগুলি মনে করায়। কী অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করেছে এমন বহু মুহূর্তগুলি তা আমাদের পক্ষে অবর্ণনীয়। তা শুধু অনুভূতির ব্যাপার। পেছনে সেই বিখ্যাত কাশফুল ! বিশাল প্রান্তর! সব কিছুর মধ্যেই আমরা যেন নিজের অজান্তেই এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পড়েছি।
তবে আমাকে এই সিনেমার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত যদি নির্বাচন করতে হয় তবে তা নিঃসন্দেহে হবে ননীবালা (চুনিবালা দেবী) সংক্রান্ত। আমরা জানি চুনিবালা কে নিয়ে কতটা উচ্ছ্বসিত ছিলেন সত্যজিৎ! সেই উচ্ছ্বাসের পুরোটাই ধরা পড়েছে ছবিটিতে এবং তা খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে। নীচের ছবিগুলি সেই সাক্ষ্য বহন করে –


এমনকি ছবি মুক্তির পর তাঁর অভাবে বেদনাহত অপরাজিত – বিমলার ছবিটিও আমাদের এত আনন্দের মধ্যেও বিষণ্ণ করে তোলে। শুনেছি সন্দীপ রায় বলেছেন কিছু কিছু জায়গায় প্রায় শিহরিত হতে হয়েছে! প্রথমে বিশ্বাস করিনি কিন্তু আমারও তাই হয়েছে। এবং সেজন্য পরে টিভির অপেক্ষা না করে পর্দায় দেখা সার্থক।
অভিনয় সব্বাই যথাযথ। জীতুর কথা বা সায়নীর কথা অনেকেই বলেছেন। আমি আলাদা করে বলব অঞ্জনা বসুর কথা। ছোট্ট দু-তিনটি দৃশ্যেই তিনি দিব্যি আমাদের মন কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। মনে পড়ে যায় সত্যজিতের ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পটির কথা। এমনকি এই দৃশ্যে জীতুকে যেন একটু হলেও ম্লান লাগে তাঁর পাশে।
দু-একটি ত্রুটির দিকে দৃষ্টিপাত করাই যায়। সাংবাদিকের চরিত্রে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশ দুর্বল লেগেছে। হয়তো চরিত্রটির এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, তা সত্ত্বেও বলব এই জায়গায় কোন চরিত্রাভিনেতা থাকলে ব্যাপারটি অনেক বেশি প্রাণবন্ত হত, নিদেন আমার পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রীর চরিত্রটিও যেন একটু নড়বড়ে, ঠিক সেই বিশাল মানুষটির ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠেনি। আর সত্যজিতের মধ্যে একটি সরস সহাস্য মানুষ ছিল। তাঁর সজোরে হেসে ওঠার বা সেরকমভাবে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোন দৃশ্য চোখে পড়ল না। দুটি দৃশ্যে, দুর্গাকে আবিষ্কারের মুহূর্তে বা ঐ টেকো লোকটিকে খুঁজে পাওয়ার সময়ে হয়তো এই উচ্ছ্বাসের প্রকাশ রাখা যেত। তবে এই ত্রুটিগুলি খুবই নগণ্য। মূল কাহিনি যাঁকে নিয়ে তাঁর চরিত্রের সবদিক ধরতে গেলে এই কাহিনিচিত্রটির দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হতে পারত। সেটি আবার ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতে পারত।
তবে নিঃসন্দেহে এই ছবিটি ভারতীয় বা বাংলা চলচ্চিত্রের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সাহস করে অনীক দত্ত যে এমন একটি বিষয় নিয়ে ছবি করতে ঝাঁপিয়েছেন তা অভিনন্দনযোগ্য। তিনি জানতেন বিষয়টি বাঙালি মানসের এত কাছের যে তাঁকে একেবারে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Tightrope Walking’ করতে হয়েছে।
এবং আরও অভিনন্দন বাঙালি দর্শককুলকে। তাঁরা নিঃসঙ্কোচে ছবিটির সমাদর করেছেন। সারা ভারত জুড়ে ছবিটির প্রদর্শনে তাঁদের উৎসাহ চোখে পড়ার মত। ছবিটি আমি তাড়াহুড়ো করে ব্যাঙ্গালোরে একটি হলে গিয়ে দেখেছি, ভয় ছিল চলে না যায়। অবাক হয়ে দেখেছি পরের সপ্তাহে আবার আরও একটি অপেক্ষাকৃত কাছের হলে ছবিটি এসেছে। জনশ্রুতি ভারতের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা।
বাংলা চলচ্চিত্রের পক্ষে এটি খুবই এক আশাপ্রদ সংকেত। আমরা, সত্যজিৎ ও বাংলা সিনেমার অনুরাগীরা সকলেই চাইব বাংলা সিনেমা আবার সগৌরবে তার উচ্চস্থান দখল করুক। তার শুভারম্ভ হোক সত্যজিৎ শতবর্ষে ‘অপরাজিত’র হাত ধরেই।

সুন্দর সমালোচনা।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ!
LikeLike
Anik has done a marvelous thing. Amar ek bochorer senior, tui tokari kortam, ghiyer tin boley daktam. My sentiments are parallel to yours. But Sayoni was not up to the mark.
LikeLiked by 1 person
দেখবোই
LikeLiked by 1 person
অবশ্যই!
LikeLike
দর্শন-প্রতিক্রিয়া (সমালোচনা না বলাই ভাল) সুন্দর হয়েছে, আমিও প্রায় প্রতি মন্তব্যের সাথে একমত। কয়েকটি জিনিষ চোখে লেগেছে, যেমন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের ‘জোকার্তুমি’। তিনি কি এত হাল্কামাপের লোক ছিলেন? ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র আর শিল্প-নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত অসাধারণ নির্বাচন, ছোট্ট রোলে রবিশংকর বা নেহেরু অসামান্য। তবে সত্যজিতের চিত্রপরিচালক হয়ে ওঠার পেছনে মা সুপ্রভা রায়ের অবদান তেমন দেখানো হয়নি কেন জানিনা, বিজয়া রায়কে প্রমিনেন্ট করার জন্যেই কি?
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ পল্লব!
LikeLike
প্রত্যেকটি চরিত্রের আসল নাম দিতে গেলে প্রত্যেকের বংশধরের কাছ থেকে NOC নিতে হতো। সন্দীপের আপত্তিতে শাপে বর হয়েছে।
তবে চরিত্রগুলির নাম এমন সুচিন্তিত ভাবে দেওয়া হয়েছে,যাতে শোনা মাত্র আসল চরিত্রটিকে চিনতে অসুবিধে না হয়।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ! চরিত্রগুলির নাম সুচিন্তিত, সেটা আমিও লিখেছি। আমার একটা প্রশ্ন আছে। সব বায়োপিকেই কি তাই? সুভাষচন্দ্রের ওপর শ্যাম বেনেগাল যে বায়োপিক করেছেন বা গান্ধীর ওপর রিচার্ড এটেনবরো যে বায়োপিক করেছেন, তাতে কি সব চরিত্রের পরিবারের কাছে অনুমতি নিতে হয়েছে?
LikeLike
রায় সাহেবের সাড়া ফেলেদেওয়া “পথের পাঁচালী” ও আজকের অনীকবাবুর “অপরাজিত” নিয়ে খুব সুন্দর এক প্রবন্ধ উপহার দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
LikeLiked by 1 person